জানি না এখন তুমি কোথায় কেমন আছ মাগো
এক ঘুটঘুটে অন্ধকার অজ্ঞাত মৃত্যুর গুহায়
দাঁতে দাঁত চেপে জীবনের শেষ নিশ্বাসটুকুর জন্যে
লড়াই করছি আমি! প্রতীক্ষা করছি জীবনের।
জীবনের মধুরতম মমতা আমাকে ঘিরে আছে,
আমার প্রাণের মধ্যে এখনো শোনা যায় মর্মর জীবনস্পন্দন।

নির্জন শীতল এক প্রকোষ্ঠে মেঝেতে ঠেকিয়ে পিঠ
চোখ-হাত বন্দি, পড়ে আছি জন্মান্ধের মতো
পৃথিবীতে এত আলো তবু আজ কোনো আলো নেই
আমার চোখে। শুধু তোমার মুখ ছাড়া হৃদয়ে আর
কিছুই দেখতে পাচ্ছি না মাগো, মনে হয় পৃথিবীর
চারভাগ আজ অন্ধকার সূর্যের পতনে। তুমি কোথায়
কেমন যে আছ গ্রামের সরল মেয়ে দুঃখিনী মা আমার।

হয়তো আমার নিরুদ্দেশ নিখোঁজ সংবাদ এতক্ষণে পৌঁছেছে
তোমার কাছে। শোনামাত্র বিশাল চিৎকারে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছ,
হাত থেকে পড়ে গেছে ধানভর্তি কুলা, উড়ে গেছে ডাল থেকে
কা-কা শব্দে কাক। গাঁয়ের মানুষ এসে বুঝি ইতোমধ্যে
ভরে গেছে বাড়ির উঠোন। কখনো সামান্য অভিমানে
বাড়ি না ফিরলে অস্থির পাগল প্রায় তুমি দিশেহারা হতে,
আর আজ এই ভয়ংকর, নিষ্ঠুর নিখোঁজ সংবাদ কী করে সইছ তুমি?
কী আমার অপরাধ? কী অন্যায় করেছি যে এভাবে বলপূর্বক
অপহরণ করে ধরে এনে চোখ হাত বেঁধে নির্মম পশুর মতো
ওরা আমাকে মারছে? নির্যাতনের নৃশংসতা দেখাচ্ছে,
চাবুকে রক্তাক্ত করছে আমার দেহ, কসায়ের মতো কড়িকাঠে
রাখছে ঝুলিয়ে। দম বন্ধ হয়ে আসে। মানুষ যে মানুষের ওপরে
এতটা নির্মম বর্বর হতে পারে আগে ভাবিনি কখনো।

সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলছি একবার, কখনো আবার চিৎকার করছি
আঘাতে। আমার চিৎকারে হয়তো এ কঠিন প্রস্তর ককিয়ে উঠছে ব্যথায়,
তবু থামে না তাদের নিষ্ঠুর নির্মম চাবুকের কষাঘাত। ওরা মানুষ
নাকি মানুষের বেশে হিংস্র জানোয়ার কোনো?
ক্লান্ত ওরা বেহুঁশ আমাকে রেখে গেছে আসবে আবার সংজ্ঞা ফিরেছে
কুত্তাগুলো ফের খামছে কামড়ে আমার রক্তের স্বাদ নেবে।

রাতে জ্বর ওঠে।
সমস্ত শরীর টনটন করে দুঃসহ ব্যথায়
ফুলে গেছি পাণ্ডুরোগীর মতন
ফিরতে পারি না পাশ, কোনোরকমে কাঁধের ভর দিয়ে কনুয়ে
দেয়াল ঘেঁষে ঠেকাই পিঠ। তৃষ্ণায় শুকিয়ে গেছে বুক,
জিভ চুষি থুথু তাও নেই মুখে
ক্ষুধার ঈগল কামড়ে খায় নাড়িভুঁড়ি।
মাগো, কোনোদিন দাওনি তুমি ফুলের টোকাও শরীরে আমার
একবার বাবা খুব কথা না শোনায় রাগ করে মেরেছিল তুমি সারারাত
বিছানার পাশে
জেগে কেঁদে ভিজিয়েছ আমার কপালের পট্টি,
রাগ করে তিনদিন কথা বলোনি স্বামীর সঙ্গে।
মা, তোমার সেই আদরের দুলালকে পশুরা উল্লাসে রক্তাক্ত করছে,
হয়তো জায়নামাজে হাতজোড় করে বসে আছ তুমি সারারাত্রি
তোমার চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে আল্লার আরশ,
পুড়ে নিঃশেষ হচ্ছে ধূপ ধবধবে পোশাকে ফেরেস্তা নেমে আসছে
তোমার জায়নামাজে।

আমাকে ফিরিয়ে দাও পাখির গান, ফিরিয়ে দাও
মিছিলে মিছিলে উদাত্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বান্ধবীর মুখ,
বটতলা, মধুর ক্যান্টিন, লাইব্রেরির সবুজ চত্বর।
আমি ফিরে যেতে চাই
ফিরে যেতে চাই জীবন যেখানে জেগে উঠছে উল্লাসে
লড়াইয়ে
সংগ্রামে
মিছিলে।
শুনতে পেলাম ওরা আমায় হত্যা করবে
অভিযোগ রাজদ্রোহিতার; বেআইনি আইন ভাঙার
অপরাধে অপরাধী আমি, ভয়ংকর শত্র“ এক আমি ওদের
বিরুদ্ধে। কিছুতেই ওরা ছাড়বে না আমায়
মৃত্যুর হিমস্পর্শ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো
ছুঁয়ে যাবে আমার কবোষ্ণ ঠোঁট। নির্জন অজ্ঞাত কোনো
স্থানে ওরা ফেলে রেখে আসবে আমার বেওয়ারিশ লাশ,
অথবা জনমনিষ্যির দৃষ্টি থেকে দূরে সরিয়ে দেবে।

কোনোদিন আর মানুষের মাঝে পারব না আমি ফিরে যেতে,
অন্যায়ের বিরুদ্ধে জ্বলন্ত বিদ্রোহের আগুন ছড়াতে গ্রামে, গঞ্জে,
শহরে, নগরে, আর আমি ডাক দিতে পারব না
সর্বহারা নিপীড়িত মানুষকে। মা-রে কোনোদিন আর দেখবো না
সৌম্য তোমারই মুখ, নারকেল নাড়–, কাউনের মোয়া,
তিলভর্তা, পুঁটিমাছ ভাজা, পান্তাভাত, দুধের নরম পিঠা
আর পাবে না আমার øেহার্দ্র রসনা।
খুঁজে কেউ আমাকে পাবে না কোনো কারাগারে, সেলে
শেয়াল শকুন ছিঁড়ে খাবে বেওয়ারিশ লাশ,
দীর্ঘশোকে ছেয়ে যাবে বাংলাদেশ; তবু
নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদ শুনবে না তোমার বুকফাটা আর্তনাদ।

ওরা অস্বীকার করবে আমার গ্রেফতার; অগ্রজ
জহির রায়হানের মতো হারাব চিরনিখোঁজ আঁধারে।

কিন্তু জেনে রেখো মাগো, তোমার ছেলেকে হত্যা করে
ওরাও রেহাই পাবে না; ওদের মৃত্যুর ঘণ্টা আমি বাজিয়ে
দিয়েছি; সংগ্রামী জনতা রাজপথে; আমি সর্বত্র
জ্বালিয়ে এসেছি আগুন। আমার হত্যার প্রতিবাদে
যে আগুন ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়বে, সে আগুনে পুড়ে
নিশ্চিহ্ন হবেই ঘৃণ্য জঘন্য বর্বর পুঁজিবাদ।

যারা হত্যা করে, খুনি যারা, যারা নির্যাতন করে,
যারা কেড়ে নেয় মানুষের ন্যায্য অধিকার স্বাধীনতা,
সাম্য, বিপ্লবকে যারা স্তব্ধ করে দিতে চায়
তোমার ছেলে মৃত্যু সংগ্রামের প্রাণ হয়ে উঠবেই
শাসক-শোষকের মৃত্যুঘণ্টা বাজছেই, বিপ্লবের বহ্নিমন্ত্র
ছড়াবেই প্রাণে প্রাণে, জেগে উঠবেই অসহায়, পঙ্গু
নিরক্ষর নিঃস্ব ব্যথিত মানুষ একদিন।

একদিন এই পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষের কথা বলবার,
প্রতিবাদ করবার, বেঁচে থাকবার অধিকার সুরক্ষিত হবে,
সকলেই পাবে নিরাপদ জীবনের অঙ্গীকার,
পুত্রহারা হবে না আর সেদিন কোনো মা-ই তোমার মতন
সেদিন নিখোঁজ তেমার পুত্রের সন্ধান নিশ্চিত খুঁজে পাবে মাগো,
আজকের এই নিষ্ঠুর নিখোঁজ সংবাদ মনে হবে,
এক রাত্রির দুঃস্বপ্ন শুধু।