3482

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যে কয়জন নবীন কবির দীপ্ত আবির্ভাব হয়, মোহন রায়হান তাঁদের অন্যতম। বাংলাদেশের কবিতার ধারায় কবি মোহন রায়হান এক তেজী কণ্ঠস্বর। ১৯৭১-এর রণাঙ্গন থেকে উঠে আসা দ্রোহ, প্রেম, প্রতিবাদ, স্বাধীনতা, সাম্য ও বিপ্লবের কবি মোহন রায়হান কবিতাকে কেবল শিল্প ভাবেন না বরং কবিতা তাঁর কাছে সমাজ বদলের শাণিত হাতিয়ার। জীবন ও কবিতায় সমান লড়াকু  মোহন রায়হান। কবি মোহন রায়হান আমাদের দেশের এক কিংবদন্তি পুরুষ। তাঁর জীবন ইতিহাস বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঘাত-প্রতিঘাত ও উত্থান-পতনের জটিল আবর্তনের খতিয়ান। রাষ্ট্রিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সাহিত্য আন্দোলনের ইতিহাসে মোহন রায়হান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

জন্ম
মোহন রায়হান ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সিরাজগঞ্জের কৃতিমানব আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিক, সিরাজগঞ্জের খোকশাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় ৩০ বছর নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, খোকশাবাড়ি হাসপাতাল ও ব্রাহ্ম্রণ বয়ড়া গ্রোইন বাঁধের প্রতিষ্ঠা। সিরাজগঞ্জ কওমি জুট মিলস প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোক্তা। মা মাহমুদা খাতুন আজীবন মানব দরদী, গরীব দুখি মানুষের সুখদুখের নিত্যসঙ্গী, দয়াময়ী, জনহিতৈষিনী, অত্যান্ত ধার্মিক, পবিত্র আত্মার মানুষ ছিলেন।

শিক্ষা ও কর্ম জীবন
তিঁনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
কবি মোহন রায়হান ১৯৬৯ থেকে শুরু করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সকল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও কবিতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিঁনি বাংলাদেশের একজন অন্যতম সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় কবিতা পরিষদের দুই বারের সাধারণ সম্পাদক, সাংস্কৃতিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবেরও দুই বারের সাধারণ সম্পাদক। স্ফুলিঙ্গ সাংস্কৃতিক সংসদ, সৃজন, আবৃত্তি সংসদ, বাংলাদেশ লেখক শিবির, প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি, অরণি সাংস্কৃতিক সংসদ, তাহের সংসদ, রাখাল, লেখক ইউনিয়ন, সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটিসহ অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনায় দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্র-পত্রিকাগুলোর মধ্যে সাপ্তাহিক দিকচিহ্ন, সূর্য সৈকত, স্ফুলিঙ্গ, সমকণ্ঠ,  জনান্তিক, অরণি, সাহস, দুর্বিনীত এই মাটি জ্বলে প্রতিরোধে, লাল তোমার পতাকা, ইশতেহার, বিদ্রোহের পংক্তিমালা উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে তিঁনি কবিতাপত্র দিকচিহ্ন এবং সাওল সময় পত্রিকার সম্পাদক।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দেন কবি মোহন রায়হান। তিঁনি ছিলেন সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে দেশ-কাঁপানো সাহসী ছাত্রনেতা। আশির দশকে স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের সূচনাকারী ১৪টি ছাত্র সংগঠন নিয়ে যে সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়, তিঁনি তার কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। ১৯৮৩ সালেরৈ ১১ জানুয়ারি ছাত্র-বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়ে প্রথম সামরিক শাসন ভঙ্গ করে ১০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মিছিল নিয়ে শিক্ষাভবন ঘেরাও করেন। এ অভিযোগে তাঁকে চোখ-হাত বেঁধে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী তুলে নিয়ে ২১ দিন গুম করে রেখে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে পঙ্গু করে দেয়। পরে ভারতের চেন্নাইয়ে অপারেশন করিয়ে তিঁনি চলাচলে সক্ষমতা লাভ করেন।


অর্থ, বিত্ত, সম্পদ, ক্ষমতার লোভের কাছে বিক্রি হননি, ভয় ভীতি, অত্যাচারের কাছে মাথা নত করেননি, আপোস করেনি কখনো অকুতোভয়, লড়াকু, সাহসী, সৎ, ‘মানুষের জন্য জীবন’ মন্ত্রে উদ্দীপ্ত কবি ও যোদ্ধা মোহন রায়হান।

বর্তমান বাংলাদেশে বিনা রিং, বিনা অপারেশনে হৃদরোগ চিকিৎসার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে আরেক নতুন বিপ্লবের সূচনা করেছেন মোহন রায়হান। শুরু করেছেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠির দোড়গোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেবার ব্যতিক্রমী নতুন ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলন। নিরাপদ খাদ্য, বিনা তেলে রান্না সুস্বাদু খাবার, মানুষের ফুড হ্যাবিট ও লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে নীরোগ দেহে সুস্থ্য সুন্দর দীর্ঘজীবন লাভের এক মানবিক লড়াই লড়ছেন তিনি।

প্রেমিক এবং বিপ্লবী কবি মোহন রায়হান জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে, অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ জীবনে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণ মুক্ত-সাম্য,  ন্যায় বিচার, সামাজিক মর্যাদা-তথা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন।