পুষ্পিত পল্লবিত কিশলয় শ্যামল সবুজ
কী শোনালে হে নন্দিতা নববৃক্ষ!
মর্মর মর্মন্তুদ সকরুণ এস্রাজ
সজীবতার ধ্র“পদী মায়াবী অহংকারে
শাখা নেড়ে; অবজ্ঞা বিনষ্টি গান!
চিরকাল মানুষেরা গাছেদের কাছে শোনে
পত্রধ্বনি মৃদঙ্গ বিহঙ্গ সুর
নীহারের নিরিবিলি নিঃসারণ
নীরভ্র নীলিম নীলাঞ্জন গাঁথা।

কী শোনালে হে বিষবৃক্ষ
পুষ্পবতী বৃক্ষ পুষ্পাধারে ফোটে কত পুষ্পরাগ
পুষ্পমঞ্জরী পুষ্পাভরণ পুষ্পাত্রে পুষ্পরজঃ
কী দিলে মুখোমুখি বিবস্বান কে?

কী দিলে পুষ্পোপাসক কে?
গাছের নিকুঞ্জে নাকি শুনি নিরাশ্রয়ের আশ্রয়
নীড়হারা মানুষের অধ্যাসন
পত্রপুঞ্জ অভ্যন্তরে পাখিদের নীড়
খয়েরি বাকল গর্তে নাকি বিষধর ক্রূরনাগ
নিরাপদ ঠাঁই ভেবে কুণ্ডলিত লেজ গুটিয়ে পাকিয়ে রাখে
বিষমুখ ওখানেই বদলায় নাকি জীর্ণ আকর
সিঁধকাটা বিজয়ী চোরের দল বৃক্ষতলে
সুষম বণ্টন করে চোরা সোনা মাল
দলহারা ডাকাত শুনেছি নাকি বৃক্ষকেই বেছে নেয় নির্ভর।

বেহুলার যুগে পরিত্যক্ত বণিক বিন্যস্ত
বৃক্ষকোলে পরবাসী হতো
মজনু তো অরণ্যানী চষে লায়লী…লায়লী…
অন্তুদে মাটিতে মিশে গেল শেষে
বোধিদ্রুম বৃক্ষতলে বুদ্ধ নিরিবিলি সৌম ধ্যানী
নিঃসঙ্গতার অলীক বন্ধু শুনেছি সবুজ বৃক্ষবালা।

ওখানেই নাকি প্রাকৃতিক মুগ্ধ ছায়া স্নিগ্ধ অভিসার
পত্রপল্লবে পাখির সংগীতে ফুলের সুঘ্রাণে
ফলের সুমিষ্ট আঘ্রাণে বসন্তের হলাহল
রেণুর সম্ভোগে ভ্রমরের ভ্রমণ-গুঞ্জন
ওখানেই নাকি পরিপূর্ণ যৌবন জীবন-মদ
সবুজাভ বৃক্ষ ঠোঁট ছুঁয়ে অর্কের নিস্তব্ধ ঘুমভাঙা
প্রকৃত ওটাই নাকি শ্রেষ্ঠ পীঠস্থান; মক্কা মদিনা মথুরা
গির্জা ও মন্দির মসজিদ কিছু নয়,
গোপন গেরিলা সাথি, আজন্মের বাসভূমি
নীড়হীন মানুষের পরিচিতি।

কণ্টক বৃক্ষ! কণ্টক শুধু! সুঁচ্যাগ্র কণ্টক!
অকাল প্রজ্ঞায় তত্ত্বজ্ঞানী কিশোরীর মতো
নক্তন্দিপ জন্মাবধি মুগ্ধ অশ্বত্থায়
বটফুলে স্তবক স্তবক বটমূলে মাল্যদান
অবজ্ঞা পৃথুল গগন তানুকে সুসমৃণ পৃষ্ঠদেশ!

নব কিশলয় যদি থাকে চির সজীব সবুজ
কবিদের আর কোনো দুঃখ থাকবে না পত্রের রঙে রঞ্জিত করবে
আকাশ মৃত্তিকা পাহাড় মিথুন সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে রঙমহল
বৃক্ষ দুঃখ সবে না, কবির প্রাণ!
পঞ্চবটি বনে থেমে যাবে ক্রৌঞ্চ, স্বর্ণাভ মৎস্যেরা আক্রায় পড়বে,
নুড়ির ভেতরে কান্না জেগে উঠবে।

বৃক্ষ ফুল ফল শ্যামলিম পত্রাবলি রম্ভার শরীর
ছিঁড়েখুঁড়ে স্বর্ণারক্ত শুষে নিলে কোনো সর্বনাশা কীট
নির্জীব মলিন হলে খসে গেলে বিশীর্ণ বাকল, ঝ’রে গেলে
পুষ্পপত্রাবলি
ক্ষয় হলে কুমকুম বৃক্ষ, কবির দুঃখ আর দুঃখ সীমা মানবে না
কবির ক্রন্দন শোনা যাবে মধ্যরাতে
সজীব সবুজ বৃক্ষ ছাড়া আঙুরের মতো টসটসে কবিতা হবে না।

হে নববৃক্ষ!
কবিরা তো দুঃখবাদী বুকের মাটিতে দুঃখ চাষ করে
কষ্টের লাঙল চ’ষে থোকা-থোকা ব্যর্থতা বপন করে যাব
তুমি সুখ চাও! সুখ চাও
যাও অনন্ত ঐশ্বর্য অসীম সুখের স্বর্গে যাও।
মানুষদের মতো বৃক্ষ কবিদের কিছুই দেয়নি,
সবুজের ঘ্রাণ, মল্লিকার হাসি, পত্রের সংগীত কিংবা ফলের চুম্বন।

গণিকার মতো আজ হৃদয়ের ছলাকলা নিয়ে বৃক্ষ তুমি চলে যাও,
সুরম্য প্রাসাদ কার্নিশে মসৃণ দরজা, জানালা, টেবিল চেয়ার,
আলনা ড্রয়ার,
শেলফ্ শোকেস, আলমিরা, মিটসেফ, ড্রেসিং গ্লাস, ফ্রিজ, টিভি,
সুদৃশ্য কার্পেট, মূল্যবান সোফা, সুবিশাল পালঙ্কের কাছে।
কবি তো শব্দের নেশাচুর খৈয়াম
নিঃসঙ্গের সাকি, কবিদের আছে কী?
হাঁসের পালক, ঘাসের নরম পেলবতা, নিসর্গের নীল
মনের বিচিত্র বর্ণচ্ছটা।
কবিরা কল্পনাতাড়িত, নারীর সুষমা ও বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর
শুধু কবিতা ছাড়া আর কী আছে তাদের?
কবিরা তো আত্মম্ভরী, নৈরাশ্যবাদী, মনোমদ
অহেতুক ছিঁড়েখুঁড়ে আপন রক্ত মাংস পান করে অলীক সুধা।
অষ্টপ্রহর ঘরে ফিরে আসে না, ক্ষুধা ক্লান্তি, ভগ্ন মগ্ন
নগ্ন মধ্যরাত, অসিত দুপুর বিষাদিত বুক, লোহিত আঁখির তারায়
পৃথিবী পোড়ে।

ফলবতী, ধবল দুধালো বৃক্ষ, চলে যাও, চলে যাও, তুমি
সেই উষর ধূসর বিরান বিথান মরুভূমি ছেড়ে সুনীল সবুজ দ্বীপে।
প্রেমতরঙ্গ, প্রেমানন্দ, হৃদয় অধিক ভালোবাসা চুম্বন মদিরা ছাড়া
যার আর কিছু নেই,
তার দিকে আর ফিরে তাকাবার দরকার কী আছে?
কেন ‘মুখোমুখি’ হয়ে ছিলে এমন পূজকের?
কবিরা মরমী বলে কোনো অধিক দুঃখকে দুঃখ মনে করে না,
যে কোনো আঘাত ভাস্কর্যে খোদাই-এর মতো ধ’রে রাখে বুকে
সব ঘৃণা, অপমান, ঠোঁটে ক’রে পাখির চঞ্চুর মতো দেশে দেশে
কালে কালে
হাওয়ায় মাটিতে যায় ছড়িয়ে শুভ্র স্বপ্ন বীজ।
মাইকেল মধুসূদনের মতো পরভূমে বসে কপোতাক্ষ স্রোত গোনে,
নজরুলের মতো অশ্র“জলে রক্তের কণায় প্রতিষ্ঠিত করে হৃদয়-মানসী
প্রিয়তমা নারী!
কী বিনম্র ভঙ্গিমায় বলে:
আমার ধ্যানলোকে তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে
তাকে আর আমার হারাবার কোনো ভয় নেই।

কবিরা শিখেছে আত্মঘাতী মন্ত্র
আপনাকে পরিদাহ করে স্বাগ্নিক
দানবীয় মানবীয় তারা ছিঁড়েখুঁড়ে রক্ত মাংস অস্থি মজ্জা
চাষ করে কস্তুরী হৃদয় পারে ফলাতে সবুজ আঘ্রাণ।
সালোকসংশ্লেষণের প্রক্রিয়ায় কবিরা বৃক্ষকে দেবে প্রাণের নিশ্বাস
হায় বৃক্ষ যদিও সবুজ পল্লব চুঁইয়ে না দেয় বিজ্ঞান!

হে নববৃক্ষ!
ভয় নেই, তোমার কাঠুরিয়ার প্রতি তীব্র ঘৃণা থাক
একজন কবিকে ভয়ের কিছু নেই
কবি কিছু না-পেলেও প্রেম নারী মাটি মানুষ মানবতা
প্রকৃতির কথা বলে যাবে
কবি কাঠুরিয়া এবং মানুষের মধ্যে তফাৎ অনেক।
তোমার মুক্তি হোক, মুক্তি হোক
তুমি দিগন্তে মিলাও।

বুকের উদ্দাম দীর্ঘতায় তরতর বেড়ে ওঠো
সমস্ত আকাশ ঢেকে দাও
তোমার শ্যামল জ্যোতির্ময় দেহবল্লরীতে।

থাই পাহাড়ের মতো ভারী-ব্যথান্যূব্জ হয়ে আছে ওই বহু শতাব্দীর
পুরোনো আকাশ
বৃক্ষহীন, ছায়াহীন, পুষ্পহীন গলিত স্খলিত মরুভূমি।

৭.১১.৭৭
এনায়েতগঞ্জ, ঢাকা।