যিনি আবু তাহের কর্নেল
যিনি ফাঁসিমঞ্চে হাসলেন
তিনি এখন লজ্জায়
কালো হন, প্রতিদিন আমার স্বপ্নের মধ্যে।

গতকাল ভোররাতে আমাকে সে
নিয়ে গেল দেশের একটি সেনাবাসে
ইশারায় খুব আস্তে আস্তে তাঁর ক্র্যাচে
হেঁটে হেঁটে সারি সারি জোয়ানের
কবরের পাশে দাঁড়ালেন।

অনেকের গলায় ফাঁসির চিহ্ন
কারো বুক গুলিবিদ্ধ, কারো দেহ থেঁতলানো,
তারা প্রত্যেকেই হঠাৎ জেগে উঠল
অভিবাদন জানাল পেশাগত কায়দায়;
তাহের তাদের প্রত্যেকের সাথে করমর্দন ক’রে,
আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমি বিপুল উৎসাহে
আনন্দে তাদের প্রতি হাত এগিয়ে দিলাম
কিন্তু তারা প্রত্যেকে আমাকে প্রত্যাখ্যান ক’রল;
ঘৃণায় তাদের চোখ মুখ ভুরু নাক কুঞ্চিত হল।
অপমানে আমি চিৎকার ক’রতে গেলে
তাহের আমার মুখ চেপে ধরলেন;
সরে আসলেন আমাকে নিয়ে।

হাঁটতে হাঁটতে ভোরের রুপালি হাওয়ায়
বুক ভরে নিয়ে আমরা এলাম শেরেবাংলা নগর,
বিরাট চত্বর পেরিয়ে মূল্যবান পাথরে
নির্মিত কবরটির কাছে আসতেই লাফ দিয়ে দাঁড়ালেন
একজন জেনারেল, থরথর কাঁপন শুরু হল তার
হাতজোড় করে ক্ষমাভিক্ষা করলেন;
মুদু হেসে তাহের তখন তার কাঁধ স্পর্শ করলেন
বিনীত বন্ধুর মতো, নতজানু জেনারেল
তাহেরের প্রতি হস্ত প্রসারণ করলেন;
কিন্তু তাহের ভ্রƒক্ষেপ করলেন না বরঞ্চ কঠিন
শক্ত হল তাঁর চোয়াল, ঘৃণায় উপচে পড়ল চোখ।

সেখান থেকে লাল-সালু-ঘেরা এক মঞ্চে
নিয়ে এলেন আমাকে তিনি; ‘তাহের, তোমায় লাল সালাম’
হাজার জনতার ভিড়ে; তাহের তোমায় লাল সালাম
স্লোগানে ফেটে গেল আকাশ-বাতাস,
কয়েকজন ধবধবে পা’জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত
থলথলে গাল নেতা এগিয়ে এলেন তাঁর দিকে; একজন
তাঁর চোখের চশমা খুললেন, একজন তাঁর ভরাট কণ্ঠের
গম্ভীর আওয়াজ জনতার কণ্ঠে মিলিয়ে দিলেন।

কিন্তু তাহের তাদের প্রত্যেককে পাশ কাটিয়ে
ধীরপায়ে তাঁর কাঠের ক্র্যাচ ঠুকে ঠুকে
মাইকের সামনে এগিয়ে গেলেন,
বিশাল জনসমুদ্র মুহূর্তে নীরব হ’য়ে গেল।

তাহের শুধু কান্নায় ভেঙে প’ড়ে বললেন :
স্বাধীনতাযুদ্ধে আমার একটি পা শুধু উড়ে গেছে
কিন্তু আমি খোঁড়া নই
অথচ তোমরা পা থাকতেও পঙ্গু।