৬৫ বসন্তঃ জীবনের নতুন পথচলা

posted in: লেখা | 1

আজ ১ আগস্ট। আজ থেকে ৬৫ বছর আগে ১৭ শ্রাবণ ভোররাতে এই অভাগা আমি আমার দুখিনী মায়ের গর্ভাধার থেকে এই দুনিয়ার আলো হাওয়ায় চোখ মেলেছিলাম। যে দুজনের স্বপ্ন-আকাঙ্খার ফসল হয়ে আমার জন্ম, তাঁদের একজন ৩১ বছর আগে বিদায় নিয়েছেন, এ নশ্বর পৃথিবী থেকে, বিশ্বের প্রধান ঘাতক রোগ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, আরেকজন মাত্র তিন মাস আগে, বর্তমান ব্রক্ষ্মাণ্ড তছনছ করে দেয়া মহামারী করোনার ভয়াবহ ছোবলে। দুজনেই আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষদের অন্যতম। নিজের জীবনের চেয়ে অন্যের জীবনকে বেশি ভালবেসে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া মানুষরাই তো শ্রেষ্ঠ মানুষ। হ্যা, আমার বাবা মা দুজনেই ছিলেন তেমন মহামানুষ। তাঁরা ছেলেমেয়েদের নিয়েও তেমনি স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু আমরা কোনো সন্তানই তেমন কিছুই হতে পারিনি। তবে তাঁদের সন্তানেরা সবাই তাঁদের অনুসরণ করার বা তাঁদের মতন হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। সফল হতে পারিনি। বিশেষত আমি আমার কথাই বলি-
জীবনের কাছে জন্মের ঋণ রয়েছি অঙ্গীকারে
ফালি ফালি করে এই পেশি শুধে যাব সেই ঋণ।”

আজ থেকে ৪২ বছর আগে লিখেছিলাম, এই পংক্তি। কিন্তু জন্মের কোনো ঋণ কি শোধ করতে পেরেছি? আজ ৬৬ বছরে পা দিয়ে নিজেকেই সে প্রশ্ন করছি। বিবেকের কাঠগড়ায় যদি নিজেকে দাঁড় করাই উত্তর নেতিবাচক। নিজের কাছে নিজের যে আত্ম-অঙ্গীকার, মাটি ও মানুষের কাছে , জনগণের কাছে আমাদের যে প্রতিশ্রুতি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে আমরা যে
স্বপ্নে মানুষকে জাগরিত করেছিলাম-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি তথা সমতা, সামাজিক ন্যায় বিচার, মানবিক মর্যাদা তা কি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি?
ষষ্ঠ শ্রেণির ক্লাস কক্ষ থেকে পালিয়ে ১৯৬৬’র ৬ দফা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দিয়ে, ২০০৬ সালে আগে রাশেদ খান মেনন আর হাসানুল হক ইনুর অবৈধ ক্ষমতা দখলদার, স্বৈরাচারী এরশাদের সঙ্গে এক মঞ্চে ওঠার আগের দিন পর্যন্ত ঘরে না ফেরা ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের যোগফল মেলাতে পারি না! ব্যক্তিগতভাবে, না রাষ্ট্র না কোনো ব্যক্তি, কারো কাছে কিছুই চাইনি, নেইনি। কারো কোনো কৃপাও ভিক্ষা করিনি। বিক্রি হইনি। মাথা নত করিনি। করিনি আপস বা আত্মসমর্পণ। কিংবদন্তী ব্যাংকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর লুৎফর রহমান সরকারের, ”নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারলে, চাঁদার টাকায় জীবন নির্বাহ করতে হবে” এই মহৎ বানী মেনে নিয়ে “বিশ্ববিদ্যালয় কর্ম সংস্থান প্রকল্প(বিকল্প)”-এ যোগ দিয়ে সৎ উপার্জন, সৎ জীবনযাপনে কোনো রকমে টিকে আছি এই নির্মম নিষ্ঠুর নৃশংস পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। জীবনের একমাত্র স্বপ্ন সামাজিক বিপ্লব, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সফল হইনি কিন্তু বহুজনের মতন পঁচে গলে যাইনি। আমার অমল আত্মা থেকে কোনো দুর্গন্ধ বের হয় না। ‘লাল টুকটুকে স্বপ্ন’ বেচিনি। সেইটুকু শেষ সম্বল নিয়ে স্বপ্ন-সম্ভাবনা, আশা-নিরাশার আনন্দ-বেদনা নিয়ে পথ হাঁটি।
করোনার অপ্রতিরোধ্য আক্রমণে মাকে হারিয়ে যেন নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বহারা হয়ে গেছি। কত কাছের বন্ধুদের ছিনিয়ে নিল এই ছিনাল করোনা। নিজেও সেই ভয়ংকর অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে পান্জা লড়ে বেঁচে আছি। জানি না কবে কখন কীভাবে ফুরিয়ে যাবো!
আজ প্রায় জীবন সায়ান্হে দাঁড়িয়ে যদি পিছে ফিরে তাকাই তাহলে কী দেখতে পাই? কোথাও কোনো সফলতা আছে কি? একজন কবি, রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক যোদ্ধা সর্বোপরি একজন মানুষ হিসেবে?
জীবনের একমাত্র অভীষ্ট একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি ঠিক তবে সে লক্ষ্যে যে লাগাতার আন্দোলন, সংগ্রাম আর মরণপন লড়াই লড়েছি সেই দেশপ্রেমের মধ্য কোনো ফাঁক ছিল না, তা ছিল একদম মাটির মতন খাঁটি, নিখাদ। সমস্ত সততা, বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা, হৃদয়মন উজাড় করা ভালবাসা ঢেলে দিয়ে একেকটি আন্দোলন, সংগ্রাম রচনা করেছি। আন্দোলন ছিল আমার কাছে একটি আর্ট। কবিতার মতন সৃজনশীলতা। সবকিছুর উর্ধে ছিল মানুষের মুক্তির সংগ্রাম। এমন কি প্রেমিকার প্রেমেরও উর্ধে ছিল দেশপ্রেম। যৌবনের সেই তুমুল তরুণ দিনগুলোতে বন্ধুরা যখন প্রেমিকার সঙ্গে ডেটিং নিয়ে ব্যস্ত আমি তখন বন্ধু কথাশিল্পী মঈনুল আহসান সাবেরের ভাষায়, ‘লাখ মে এক’ সুন্দরীর প্রেমাবেদনের জবাবে লিখেছিলাম- নূপুরকে পেলে ডেকে বলে দেব/ এই নূপু শোনো/ কাল মিছিল নামবে পথে/পোষাক বদলে মিছিলে আসবে/ দেখা হবে রাজপথে।” সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ড. রেজোয়ান সিদ্দিক লিখলেন-মোহন তাঁর প্রেমিকাকে আড়ালে আবডালে ডাকে না, প্রকাশ্যে রাজপথে মিছিলে ডাকে।” জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর গ্রেফতার
হলে সিরাজগন্জ থানা হাজতের গরাদের শিক গলিয়ে যে অপরূপার আবেগ উছ্রিত প্রেম আমার জীবনকে আলোকিত করেছিল, এরশাদের সামরিক শাসন ভাঙ্গার অপরাধে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর টর্চার সেলে, জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, আমার সেই দুর্লভ দুর্বিনীত প্রথম প্রেম জলান্জলী দিতে হয়েছিল, শুধু আপসহীন দেশপ্রেমের জন্যই। অবরুদ্ধ দেশ ও নিপীড়িত জনগণের মুক্তি না অপূর্ব সুন্দরী নারীর প্রেম? সেই প্রশ্নে আমি দেশ ও জনগণকেই বেছে নিয়েছিলাম। লোভ, ভয়, অত্যাচার, নির্যাতন, জীবন নাশের ঝুঁকি কোনো কিছুকেই কখনো পরোয়া করিনি। অকাল প্রয়াত কবি নিশাত খান একটি লেখায়, কতবার আমি কীভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি সেটা তুলে ধরেছিলেন। আমি নিজে একটি কবিতায় লিখেছিলাম, ‘আমার একপা থাকে রাজপথে আর আরেক পা জেলখানায়।’ জীবনকে সব সময় হাতের মুঠোয় নিয়ে, জীবনকে বাজী রেখে, দেশ প্রেমের চরম অগ্নিপরীক্ষায়, প্রচন্ড শক্তি ও সাহস নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি বলে আমি মনে করি।
কবি হিসেবে আমি কেমন? এ প্রশ্নের জবাব তো আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। আমার পাঠক আর সমালোচকরাই দিতে পারেন। কাউকে তোষামোদ না করা, কারো কাছে কবি জশখ্যাতির জন্য ধর্ণা না দেয়া, যে কারো রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা, সাহস নিয়ে যে কোনো শাহেন শাহ্-এর মুখের উপর উচিত কথা বলা মানুষকে কেউ কি পছন্দ করে? বিশেষত বাংলাদেশের হিংসা-দ্বেষ, হীনতা-দীনতা টইটুম্বুর লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবী প্রজাতির অধিকাংশই আমাকে পছন্দ করে না, তাদের মেরুদণ্ডহীনতার বিরুদ্ধে আমি থুথু দিয়ে শুরু করেছিলাম বলে- তোমাদের লোভাতুর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব আমি/অলীক উচ্চারণে যারা নিজেদের ভেবে থাক কবি/ভূমিতে শিকড়হীন যে বৃক্ষ বাড়েনি তার মূলের মাটিতে/ সেই শিল্পতরু আজ আমাদের প্রয়োজন নেই/আমাদের জীবনের জন্য আজ শিল্প চাই/ফিরে চাই মাটির আঘ্রাণ/তপ্ত অঙ্গীকার বুকে নিয়ে আমি সেই শোভন আগুন আজ ছড়াব সময়ে/তোমাদের মুখে আমি থুথু দেই থুথু দেই থুথু দেই /এতটুকু সম্মান আজ দিতে রাজী নই/মুখচোরা ভীরুটে শিক্ষক বেজম্মা দালাল বুদ্ধিজীবী/ তোমার মাথার খুলি আমি আঘাতে উড়িয়ে দেব।’এমন ঘোষণা দেয়া কাউকে কি বিদ্যমান, খ্যাতিমান, প্রতিষ্ঠিত, প্রচলিতরা স্বীকৃতি দেবে? শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুস লিখেছিলেন- মোহন মানেই যুদ্ধ।” হ্যা, যুদ্ধে যুদ্ধেই কাটছে জীবন। তাই কিছুটা স্বীকৃতি মিলতে ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমার পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলার জ্ঞানবাঘ, কবি, লেখক, গবেষক, চিন্তক আমার পরম বন্ধু অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের সম্পাদনায় যে সংবর্ধনা গ্রন্থ ‘সাহসী মানুষ’ প্রকাশিত হয়েছিল তাতে দেশবিদেশের ১৯১ জন লেখক, কবি, গবেষক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিক লিখছিলেন। ৭৬৯ পৃষ্ঠার সেই গ্রন্থে উল্লেখ্যযোগ্য-শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নীরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, বেলাল চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কামাল লোহানী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মনজুরে মওলা, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আল মুজাহিদী, রবিউল হুসাইন, হায়াৎ মাহমুদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, কমরেড খালেকুজ্জামান, সেলিনা হোসেন, আনোয়ারা সৈয়দ হক, মকবুলা মনজুর, সেলিম আলদীন, মফিদুল হক, শাহরিয়ার কবীর, মুশতাক হোসেন, সমরেন্দ্র সেন গুপ্ত, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, নবনীতা দেব সেন, বুদ্ধদেব দাশ গুপ্ত, আশিস সান্যাল, মৃনাল বসু চৌধুরী, কৃষনা বসু, সুবোধ সরকার, মল্লিকা সেন গুপ্ত, সৈয়দ হাসমত জালাল, দীপক লাহিড়ী, চিত্রা লাহিড়ী, সাযযাদ কাদির, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, জাহিদুল হক, মাকিদ হায়দার, অসীম সাহা, সমুদ্রগুপ্ত, মতিন বৈরাগী, কামাল চৌধুরী, সলিমুল্লাহখান, নাসির আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, রেজওয়ানা, চৌধুরী বন্যা, ফারুক মাহমুদ, শিহাব সরকার, জাহিদ হায়দার, বিশ্বজিৎ ঘোষ, রেজাউদ্দীন স্ট্যালিন, আসাদ মান্নান, আবু হাসান শাহরিয়ার, সোহরাব হাসান, বিমল গুহ, কামাল মাহমুদ, গোলাম কিবরিয়া পিনু, ঝর্না রহমান প্রমুখ।
এদের অনেকেই আমার কবিতার ভাল মন্দ চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী বলেছেন- ‘মোহন রায়হান সমাজ-পরিবর্তনে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই পরিবর্তনের জন্য সে মার্ক্সীয় বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতার দর্শনে আস্থাশীল। এবং সে একজন নিষ্ঠাবান কবি। তাঁর জীবন ও কবিতা একসূত্রে গাঁথা। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে এই ধারার একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আছে। মোহন রায়হান তাঁর স্বকীয়তা নিয়ে ওই ধারার একজন উল্লেখযোগ্য কবি। বিপ্লব ও বিদ্রোহ মোহনের কবিতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও তাঁর কবিতা একমুখী নয়। বেশকিছু প্রেমের কবিতা আছে তাঁর। ওই কবিতাগুলি কখনো গাঢ় আবেগে উত্তাল, কখনও স্নিগ্ধ মাধুর্যে কোমল। কখনও কখনও তিনি ছন্দ নিয়ে খেলা করেছেন, কখনও ভাষা নিয়ে।’
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন- ‘মোহন তাঁর লেখা একটি কবিতায় মাইকেল মধুসূদন ও নজরুল ইসলামকে স্মরণ করেছে। সেটা খুবই স্বাভাবিক। ওই দুই কবির মতোই সেও বিদ্রোহী, বলা যায় বিপ্লবী। তুলনার প্রশ্ন অবান্তর কিন্তু তাঁর কবিতায় মাইকেল মধুসূদনের উপস্থিতিটাই বিশেষভাবে গ্রাহ্য। মাইকেলের মতোই সে প্রথাবিরোধী এবং মনে-প্রাণে বাঙালি-পরিস্থিতি যাকে বিপরীত দিকে ঠেলতে চায় কিন্তু নিজ ভূমির প্রতি ভালবাসায় সে অনড়।”
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন- ‘জন্মান্ধ উৎসাহ ওর রক্তগত। ওর ক্রোধ আর দ্রোহের উৎস প্রেম। একটা সুখী ও মানবিক পৃথিবীর স্বপ্ন ওকে উজ্জীবিত করে, তার বিপর্যয় ওর ভেতর ক্রোধ জাগায়। এজন্যেই ওর সারাজীবনের পদচারণা ভালবাসা থেকে বীর রসে, বীর রস থেকে রুদ্রে। ওর প্রধান পরিচিতি উচ্চকণ্ঠ কবিতায়, হয়ত ওর সচেতন অবচেতন আকুতিও তাই। কিন্তু ওর নিবিড় ও নিম্নকণ্ঠ কবিতার সিদ্ধিও যে বেশ গভীর তা অনেকেরই চোখে পড়ে না। ওর প্রেমের কবিতা, স্বপ্নের কবিতা পাঠকের বেঁচে থাকার ইচ্ছা বাড়িয়ে দেয়। ওর ভয়-ধরানো আশাবাদ ও নৈরাশ্য, দুর্ধর্ষ ক্রোধ ও নিষ্ক্রিয়তা, পেলব প্রেম আর মানবতার স্বপ্ন সব নিয়ে ওকে শুভেচ্ছা।’
শামসুর রাহমান বলেন- বাংলাদেশের প্রতিবাদী কবিতার ধারা যে ক’জন কবির অবদানে বেগবান হয়ে উঠেছে, মোহন রায়হান নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। এ তেজী তরুণ কবি কবিতাকে ব্যবহার করেন সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে। তাই তাঁর কবিতা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে অস্ত্রের মতো ঝলছে ওঠে, নতুন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে।’’
কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন- ‘কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেকেই বিক্রি হয়েছেন। মোহনকে আমি জানি, চিনি এবং বিশ্বাস করি সে তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম।’
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন- ‘মোহন জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছে, নির্যাতনও সহ্য করেছে কিন্তু কখনও নিজের স্থিরবিন্দু থেকে সরে যায় নি। তার কবিতার মধ্যে রয়েছে আগুন, যা অনেককে উদ্দীপ্ত করে। কবিতার আন্দোলনের সঙ্গে সে জড়িত। বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাঁর আদর্শ। আমি দেখেছি, পশ্চিম বাংলাতেও সে বেশ জনপ্রিয়। অনেক তরুণ তরুণী তার কবিতা আবৃত্তি করে।”
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান বলেন- ‘’যে কবিতা আমি লিখিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু পারি নাই। একদিন দেখিলাম আমার বন্ধু কবি মোহন রায়হান সেই কবিতা ‘সাহসী মানুষ চাই’ লিখিয়া ফেলিয়াছেন। তাহাকে অভিনন্দন জানানোই আমি আমার কর্তব্য বলিয়া সাব্যস্ত করিলাম। ভর্তি হইলাম তাহার অগুনতি ভক্তদের দলে।’
কবি কামাল চৌধুরী বলেছেন- ‘একজন কবি প্রেমিক না হলে তার পক্ষে দ্রোহী হওয়াও সম্ভব নয়। দ্রোহ এক ধরনের প্রেমেরই নামান্তর। ইতোমধ্যে তাঁর অনেকগুলো গ্রন্থ বেরিয়েছে। লালটুপি মার্কা একটা রাগী চেহারা তাঁর দাঁড়িয়ে গেলেও শুধু দ্রোহী বা বিপ্লবী বললে তার কবিতার যথার্থ মূল্যায়ন হবে না। ভেতরে ভেতরে এক অসাধারণ প্রেমিক লুকিয়ে আছে তাঁর কবিতায়। তাঁর প্রেম, তাঁর ভালবাসা, তাঁর স্বদেশ- সেই সঙ্গে প্রিয় নারীর সান্নিধ্যের কুহকও জড়িয়ে আছে কবিতার পরতে পরতে।’
অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন- ‘’সঙ্ঘশক্তির জাগরণ দিয়ে, ঐতিহ্যের শক্তি দিয়ে, লোকজীবনের সাহস দিয়ে মোহন রায়হান নির্মাণ করতে চেয়েছেন একটি নতুন পৃথিবী। কবিতায় এই নতুন পৃথিবীর সন্ধান তাঁর উপনিবেশবাদ-বিরোধী মানসিকতারই আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ। শোষণমুক্ত একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার বাসনায় তাঁর কবিতায় এসে মিশেছে সাম্যবাদী যুবক, গ্রামীণ কালো চাষা, সর্বহারা শ্রমিক। উপনিবেশবাদ-বিরোধী এই বৈশিষ্ট্যই বাংলাদেশের কবিতার ধারায় মোহন রায়হানকে এনে দিয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা, প্রাতিস্বিক প্রতিষ্ঠা।’’
তবে এ কথা ঠিক যদি আমি বাংলাদেশের নিরাপদ, নিরামিষ কবিদের মতন শুধু লিখেই খালাস হতাম, যদি সার্বক্ষণিক লেখক হতে পারতাম, তাহলে আমার লেখার পরিমাণ এবং মান আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। একজন কবি ও যোদ্ধার পক্ষে বিশেষ করে এক জীবনে একই সঙ্গে অনেক কিছু করে সেই দায়িত্ব পালন সত্যি দুরূহ।
এবার আসি মানুষ হিসেবে আমি কেমন? আমি বরাবরি বলি- আমি ৭০% ভালো আর ৩০% খারাপ মানুষ। আমি রাগী, জেদী, উদ্ধত। কখনো কখনো চরম উদ্ধত। মাথা গরম, ক্ষেপে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। নেতা, পাতিনেতা, মাস্তান, গুন্ডা, বদমাশ, সন্ত্রাসী, এমপি, মন্ত্রীদের গায়ে হাত উঠানো মানুষ আমি। অনেক মারামারি, পিটাপিটি, ভাঙ্গচূড়, জ্বালাও পোড়াও করেছি। অনেকেই আমাকে পছন্দ করে না। অনেকেই ভয় পায়। কেউ কেউ গুন্ডা, মাস্তান ভাবত এক সময়। কিন্তু কাছে থেকে আমাকে যারা জানে তাঁরা ঠিক তার উল্টো কথাই বলবে। আবারও বন্ধু সাবেরকে উল্লেখ করতে হচ্ছে, রাইটার্স ক্লাবে আমার এক জন্মদিনে সে বলেছিল-ওর রাগী স্বভাবের কারণে মোহন হচ্ছে আমাদের জেনারেশনের সবচেয়ে মিস আন্ডারস্টুড পার্সন, মোহন নারকেলের মতন বাইরে যেমন শক্ত ভিতরে তেমনি নরম।”
বুদ্ধি দিয়ে নয় আমি হৃদয় দিয়ে চলি। তাইতো জীবনে এত কষ্ট! এত আঘাত! এত একাকিত্ব! এত বঞ্চনা! এত নিঃস্বতা! এত ব্যর্থতা! এত পরাজয়! হৃদয়ে এত রক্ত ক্ষরণ! তবু আমি মানুষকে ভালবাসি। বারবার ভুল করি। ভুল করে ভুল ভালবেসে হুল ফোটাই হৃদয়ে! রক্তাক্ত হই। বন্ধু ভেবে বিষধর সাপকে বুকে তুলে নেই আর তার ক্রুর দংশনে নীল লখিন্দর সর্বাঙ্গ জর্জরিত হই তীব্র তীক্ষ্ণ বিষে! জীবনানন্দের ভাষায় ‘ব্যবহৃত, ব্যবহৃত’ আর ব্যবহৃত আমি। কত মানুষের যে উপরে ওঠার মই হিসেব বাড়িয়ে দিয়েছি এই ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত কাঁধ! না, কোনো কিছুর প্রত্যাশায় নয় নিছক মানবতাবোধে কিন্তু অধিকাংশ অমানুষেরা বেঈমানী, বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। বিনা কারণে সেইসব নপুংসকেরা পিছন থেকে আমুল ছুরি বসিয়ে দিয়েছে পিঠে। সামনে আসার সাহস হয়নি। অনেক ভেবেছি কেন ওরা এমন করেছে? কারণ কিছুই নয়, শুধু হীনমন্যতা। দুই ধরনের মানুষ হয়, এক ধরনের মানুষ আজীবন উপকারীর উপকার কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্বীকার করে আনন্দ অনুভব করে আরেক প্রকারের মানুষ হয় যারা উপকারীর উপকার স্বীকারে নিজের পূর্বাবস্থার কথা মনে করে নীচুতার কষ্টে ভোগে। বিড়ালের বালি দিয়ে মল ঢেকে রাখার মতন নিজের অতীত সব চাপা দিয়ে রাখতে গিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। পারলে তার জীবন বদলে যাওয়ার অনুঘটককে খুন করে গুম করে ফেলতে চায়। কেন জানি না, কীভাবে যেন এসব কুলাঙ্গারেরা আমার চারপাশে ভাল মানুষ সেজে আবির্ভূত হয়! আমার ঝুলিতে এসব নরাধমদের লম্বা তালিকা রয়েছে। শুনে চমকে যাওয়ার মতন নামও আছে! সেসব সুযোগ সন্ধানী, তদবীরবাজ, ভন্ড, প্রতারক, ধান্ধাবাজ, শিয়ালেরা পদ, পদবী, পুরস্কার, অর্থবিত্ত, সম্পদ লাভের জন্য সময় মতন পদলেহন করবে আর কাজ উদ্ধার হলে নির্লজ্জের মতন চোখ উল্টে দেবে! কত মানুষ যে আমার টাকা মেরে দিয়েছে। বিপদের কথা বলে টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। সে তালিকা বেশ লম্বা আর পরিমানও মোটা অংকের। সে তালিকায় কবি, লেখক, রাজনীতিকরাও আছেন!
বিশ্বাস করুন আর নাই করুন আমার সঙ্গে যাদের বিরোধ হয়েছে তাদের ৯৯%-এর ম্যাকেয়েভ্যালী মনমানসিকতা ও চরিত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে আমার কারণে নয়। আমার জীবনের সেইসব বিচিত্র মানুষ আর অভূতপূর্ব ঘটনা নিয়ে আমি লিখছি। সেইসব জঘন্যতম বেঈমানী, বিশ্বাসঘাতকতার দুর্বহ বেদনার স্মৃতি বুকে নিয়েও আমি কিন্তু থেমে নেই মানব কল্যাণের ব্রত থেকে। এখনও যে কোনো সময়, যে কোনো পরিস্থিতিতে আমি ছুটে যাই বিপন্ন মানুষের পাশে-মধ্যরাত, ভোরবেলা, ঝড়-বৃষ্টি, তুফান, সাইক্লোন, করোনা কিম্বা যে কোনো ভয়াবহ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে। রাস্তায় কোনো গরীর রিক্সাওয়ালাকে পুলিশ কিম্বা মাস্তান মারছে, সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে কিম্বা এড়িয়ে যাচ্ছে, আমি কিন্তু এখনও এগিয়ে গিয়ে তার প্রতিবাদ করি, তাকে রক্ষা করি। এখনও নিজের সচ্ছলতা সৃষ্টিতে সক্ষম না হলেও কখনো কখনো সাধ্যের বাইরে এমনকি ঋণ করে হলেও অসহায়, দরিদ্র মানুষকে সহযোগিতা করতে পিছপা হই না। নিজের সঞ্চয় বলতে কিছুই নাই। করোনায় এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে ঋণ করে মায়ের চিকিৎসার হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে হয়েছে। বেতন, বাড়ি ভাড়া, ট্যাক্স, বিজ্ঞাপনের বিলসহ নানাবিধ বকেয়ায় জর্জরিত। কিন্তু হাল ছাড়িনি। সমাজ বিপ্লবের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা প্রতিমুহূর্তে কষ্ট দিলেও স্বপ্ন ত্যাগ করিনি। আমরা পারিনি তাই বলে কি সমাজ বদলাবে না? এভাবেই কি ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, লুঠ আর চোর, ডাকাত, দুর্নীতিবাজ, ঠক, বাটপার আর গণদুশমনদের গণলুন্ঠনের মচ্ছব চলবে যুগে যুগে, অনন্তকাল? কোনোদিনই কি শ্রমিক পাবে না তার ন্যায্য মজুরি? মিলবে না কৃষকের ফসলের সঠিক মূল্য? খেটে খাওয়া মানুষ কি পাবে না বাঁচার মতন বেঁচে থাকার অধিকার? ব্যক্তির মত প্রকাশের পূর্ণ অধিকার তথা প্রকৃত গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, শোষণহীন সমাজ-রাষ্ট্র কি চিরকালই অধরা থেকে যাবে? সবকিছু নষ্ট হয়ে যাওয়া এক অভূতপূর্ব তস্কর সময়ে এসব মৌলিক প্রশ্ন রাতের পর রাত ঘুমাতে দেয় না। কোনো কিছুতেই শান্তি, স্বস্তি খুঁজে পাই না। অস্থির, অশান্ত, স্বপ্নাহত, বোবা কান্নায় গুমরে মরা এক আশ্চর্য জীবন ও সময় পার করছি অনাগত কোনো সুদিনের প্রত্যাশায়।
রাষ্ট্র ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে জনজীবনের আমূল পরিবর্তনে সফল না হতে পারলেও অন্যভাবে মানব কল্যাণে নিয়োজিত রেখেছি নিজেকে, সাওল হার্ট সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে, বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায়, চিকিৎসাসেবা সহজলভ্য করার, একটি স্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে। মানুষের সুস্থ্য থাকার প্রধান উপায় খাদ্যাভ্যাস এবং জীবন শৈলী পরিবর্তন। আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সেই কাজটি করে যাচ্ছি। প্রতি শনিবার বিকাল ৪টায়, ২৬ ইস্কাটন গার্ডেন রোডে, সাওল মিলনায়তনে হার্ট, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, মানসিকচাপ এসব মহা ঘাতক রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুবই প্রয়োজনীয় ফ্রি সেমিনার আয়োজন করে থাকি। সারাদেশে যে যেখানে এই সেমিনার আয়োজন করতে চায়, আমরা ছুটে যাই এই জনসচেতনতামূলক সেমিনার আয়োজন করতে। বিগত বছরগুলোতে আমরা, বড় বড় হাসপাতাল বলেছে- আগামীকাল অপারেশন না করলে এই রোগী যে কোনো সময় মারা যেতে পারে।” এরকম ৬০ হাজারেরও বেশি রোগীকে আমরা বিনা রিং, বিনা অপারেশনে সাওল চিকিৎসায় সুস্থ রেখেছি আর কয়েক লক্ষ মানুষকে সুস্থ জীবনের জন্য লাইফস্টাইল পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছি। আমি আশা করি, বাংলাদেশের চিকিৎসা জগতে নতুন দিগন্তের সূচনাকারী সাওল চিকিৎসা পদ্ধতি ‘সুস্থতার শিল্পীত বিজ্ঞান’ হিসেবে একটি বিপ্লব সাধন করবে।
আজ অবাক হয়ে ভাবছি কীভাবে দেখতে দেখতে পয়ষট্টিটি বসন্ত জীবন থেকে ঝরে গেছে! অথচ বালক বয়স থেকে যে লক্ষ্যে জীবনকে ধাবিত করেছি কতটুকু তার অর্জন? কার্ল মার্ক্সের যে বানী- “মানুষের জন্য কাজ” জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম, তার ছিটেফোঁটাও যদি বাকি জীবনে করে যেতে পারি হয়তো বলতে পারবো-মানুষের জন্য আমার জীবন।
আজ ৬৬ বছরে পদার্পণ করে সেই আত্মোপলব্ধির আলোকে জীবনের সেই যাত্রা নতুন করে শুরু করতে চাই।
১ আগস্ট ২০২১, ঢাকা।

One Response

  1. শাহিদা ফেন্সী

    প্রচলিত সেই কথা, জীবনে শেখার কোন শেষ নেই,।সেই শেখার পথে সেই জানার পথে আজ আরো একটু এগুলাম। আজ সকাল থেকে কবি, ব্যক্তি মোহন রায়হানকে পড়ছি,জানছি। বহু অজানারে জানার সাথে সাথে আফসোসও হচ্ছে কেন আরো আগে এই আলোর পথে আমি হাঁটিনি! এই আফসোসের ক্ষতি পোষানোর জন্য আগামী কিছু দিন মোহন রায়হান’কে জানা চেনা বোঝার জন্য আমার জাগ্রত সময়ের সবটুকু বরাদ্ধ করলাম। এই ক্ষুদ্র তুচ্ছ ভক্তের ভালোবাসা নেবেন। ভালো থাকুন কবি।

Leave a Reply