ইস্টিমার দেখতে গিয়ে আমি প্রথম যমুনা দেখি
সেই আমার প্রথম এত বড় এত খরস্রোতা নদী দেখা
যতদূর চোখ যায় শুধু নীল আর নীল
ভেবেছিলাম যমুনা বুুঝিবা সমুদ্র
পরে জেনেছি যমুনা সমুদ্র নয় নদী
আরো পরে দেখেছি যমুনা কত হিংস্র কত ভয়ংকর!

ছোটবেলা বাবা আমাকে বয়ড়ার হাটে নিয়ে গিয়েছিল
অত বড় হাট আমি আর এ জীবনে দেখিনি
অত মানুষের সমাগম অত বিচিত্র জিনিসের সমাহার
অত কোলাহল আমি সেই প্রথম প্রত্যক্ষ করি।

হাটের অদূরে স্টিমার ঘাট; যমুনার ভয়াল গর্জন
ছাপিয়ে স্টিমারের তীব্র তীক্ষè বাঁশি
হেমন্তের হলুদ বিকেল রোদে কী অদ্ভুত বিরাট এক রাজহাঁস যেন
ক্রমশ ক‚লের দিকে ভেসে আসছিল আর প্যাঁকপ্যাঁক ডাকছিল।

সে এক নতুন বিস্ময় আমার চোখে
প্রচণ্ড স্রোত আর ঢেউয়ের ধাক্কা উজিয়ে স্টিমারটি
যখন কূলে ভিড়ল আমি আনন্দে আত্মহারা!
পিঁপড়ের সারির মতন মানুষ বেরিয়ে আসছে স্টিমারের
পেটের ভেতর থেকে বাক্সপেঁটরা কত কী
লাল জামা কুলির মাথায় হৈ চৈ হাঁক ডাক।
লোকজন নেমে গেলে বাবা আমাকে
স্টিমারের ভেতর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন
সে এক নতুন দেখা নতুন বিস্ময়!
স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায়
যমুনার দিকে অনেকক্ষণ চেয়েছিলাম
আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না
কী এক আনন্দ বেদনা উথলে উঠছিল ছোট্ট বুকে!

সেই যে আমি যমুনাকে ভালোবেসেছিলাম
আজো মুগ্ধ হয়ে আছি ভালোবাসায়
যমুনার এত সর্বনাশী রূপ তবু তাকে আমি খুব ভালোবাসি।
বগাদত্ত পোড়াকুঠি কাওয়াখোলা ঘুরকা মালসাপাড়া
আটাচড়া ছাইতানতলী সয়দাবাদ মহাদেবপুর বেলতা
খলতা চরপাড়া হাটবয়ড়া ক্ষিদ্রাণী বিষ্ণুপুর
কুড়িপাড়া মেছড়া ব্রাহ্মণবয়ড়া ভাটপিয়ারী পাঁচঠাকুড়ি
আমার দেখা না-দেখা জানা অজানা কত জনপদ রাক্ষুসী করেছে গ্রাস
কেন এত হিংস্র ভয়ংকর রাক্ষুসী এই যমুনা
কোন্ শোকে কোন্ দুঃখে কোন্ ক্রোধে তুই এত সর্বনাশী?

বহুদিন বহুবার আমি যমুনাকে সে-প্রশ্ন করেছি
যমুনা কেবলই হা হা অট্টহাসিতে রহস্যের হাসি হেসেছে।
আমি একাকী যমুনায় গিয়েছিলাম সে-রহস্য উদ্ঘাটনে।
গভীর ঘুমে যখন আচ্ছন্ন চরাচর কাশবন
নৌকার বহর ঘাট পল্টুন লঞ্চ স্টিমার পাথর বোল্ডার
জেলখানা বি.এল. স্কুল কোথাও কেউ জেগে নেই
গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেছে সবকিছু
শুধু জেগে আছে একাকী যমুনা।

আমি চুপচাপ বসে রইলাম পাড়ে
তর্জন গর্জন কোনোকিছুই নেই চারদিক শুনশান
ভালোভাবে কান পাততেই শুনি কুলকুল মৃদু শব্দে
যমুনা কাঁদছে কাঁদছে কেবলই কাঁদছে।
কখনো সে কান্না কমছে কখনোবা বাড়ছে
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে গোঙায়ে গোঙায়ে যমুনা কাঁদছে
যমুনার চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে আদিগন্ত জলরাশি
যমুনা কাঁদছে যমুনা কাঁদছে যমুনা কাঁদছে…
যত বাড়ে রাত তত বাড়ে যমুনার ক্রন্দন আর হাহাকার
যমুনার সেই বুকফাটা ক্রন্দন আর বিলাপ
আর হাহাকার বাতাসে গর্জন হয়ে বেজে ওঠে।

যমুনা সত্যি খুব দুঃখী মেয়ে; খুব নরম খুব মমতাময়ী
কিন্তু কেউ জানে না যমুনার বুকের গভীরে
কী এক নিদারুণ আঘাতের হাহাকার
প্রতিনিয়ত তাকে রাগী দুঃখী জেদি বদমেজাজি
আর হিংস্র করে তোলে;
তখন সে সবকিছুকে ধ্বংস চুরমার করে দিতে চায়
প্রতিশোধের ক্রোধে ভাসিয়ে নিয়ে যায় জমিজমা ভিটেমাটি
বাড়িঘর গাছপালা জীবজন্তু মানুষের আজন্মের অর্জন স্বপ্ন সাধ স্মৃতি
নিমেষে গ্রাস করে ফেলে উন্মত্ত যমুনা
আর প্রতিদিন গভীর রাতে নিসঙ্গ যমুনা একাকী কাঁদে
কুল কুল কুল কুল।

আহা রে! যমুনা দুঃখী মেয়ে
না-পাওয়ার দুঃখ বুকে নিয়ে তোমারই মতো কোনো একজন
নীরবে কাঁদে, কেউ তা জানে না, কেউ জানে না!