মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুণের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
তোমার সেই সদাহাসিমাখা ফুল­ ঠোট
উজ্জ্বল চোখের দ্যুতি সারাক্ষণ চোখে চোখে ভাসে।
বুঝি এখনি সংগ্রাম পরিষদের মিছিল শুরু করার তাগিদ
দেবে তুমি, ওইতো সবার আগে তুমি মিছিলের।
কী সুঠাম তোমার এগিয়ে যাবার ভঙ্গিমা,
প্রতিটি পা ফেলছ কী দৃঢ় প্রত্যয়ে,
কী উচ্চকিত তোমার কণ্ঠের স্লোগান যেন
আকাশ ফেটে পড়বে নিনাদে। হাত উঠছে হাত নামছে,
মাথা ঝুঁ’কছে-ঘাড় দুলছে, চুল উড়ছে বাতাসে;
ওইতো আমাদের ঐক্যের পতাকা হাতে এগিয়ে যাচ্ছ তুমি।

মধুর ক্যান্টিনে যাই
নিত্য নতুন প্রোগ্রাম; মিছিল, সভা বটতলা
অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দুর্জয় শপথ,
সামরিক জান্তার ছোবল থেকে শিক্ষাজীবন,
শিক্ষাঙ্গণের স্বায়ত্তশাসন রক্ষার অঙ্গীকারে ডাক দিই
দেশবাসীকে; তোমারই মতো নিরাপত্তাহীনতায় প্রতিটি ছাত্রের
দুর্বিষহ জিম্মি-জীবন এখনও এ ক্যাম্পাসে, হলের গেটে গেটে।
পড়ে থাকে ভয়ংকর বিস্ফোরণোন্মুখ তাজা বোমা, প্রতিদিন চরদখলের মতো
হল-দখলের হামেশা মহড়া, গুলি ও বোমা ফাটার শব্দ এখন
আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অংশ। এ অস্ত্রের উৎস কোথায়?

না বলেই পদত্যাগ করলেন আর এক ব্যর্থ ভি.সি। আর ওদিকে
অবৈধ স্বঘোষিত চ্যান্সেলর বিশ্ববিদ্যালয় অস্ত্র ও গুণ্ডামুক্ত করার
জাতীয় ঘোষণা দিয়ে আবার নতুন অস্ত্র, নতুন গুণ্ডা পাঠায়, তোমার মতন
আমাদেরও প্রতিবাদের কণ্ঠ চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দিতে।
বসু, তোমার হত্যাকারী খুনি এরশাদের পেটোয়াবাহিনী
খোকা-পাঁচপাত্তুর প্রেতাত্মা নতুন বাংলা ছাত্রসমাজ মূলত অস্ত্রধারী অছাত্র
দু®কৃৃতিকারী
এখনও সমান সন্ত্রাস চালাচ্ছে পুলিশের নাকের ডগায় স্টেনগান, পিস্তল,
কাটা রাইফেল হাতে প্রকাশ্যে দাপাদাপি করছে তারা যদিও টিকতে পারছে না।

মধুর ক্যান্টিনে যাই
প্রতিদিন আমাদের জীবন হাতের মঠোয়
প্রতিদিন হামলা রুখতে হয়
বসু, আজ সেই প্রতিরোধের সারিতে তুমি নেই
আজ বড়ই অভাব অনুভব করছি তোমার।

শিক্ষাভবন মুখে সামরিক শাসন ভাঙার প্রথম মিছিলে তুমি ছিলে
রক্তাক্ত ১৪ই ফেব্র“য়ারির কাফেলায় তুমি ছিলে
‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল ট্র্রাক’ মিছিল চাপা দেওয়ার দিন তুমি ছিলে
সচিবালয় ঘেরাও অভিযানে তুমি ছিলে
জসীম উদদ্ীন হল গুণ্ডামুক্ত করার লড়াইয়ে তুমি ছিলে
পুলিশের তত্ত¡াবধানে অস্ত্রধারী দু®কৃৃতকারীদের আস্তানা
এফ. রহমান হলে স্টেনগানের মুখে চ্যালেঞ্জ মিছিলে তুমি ছিলে
চৌঠা আগস্ট খালিহাতে সশস্ত্র দুর্বৃৃত্তদের কবল থেকে আমাদের পবিত্র মাটি
রক্ষা করার সম্মুখ সমরে তুমি ছিলে
এমন কোন ধর্মঘট, হরতাল, ঘেরাও, মিছিল-আন্দোলন নেই;
তুমি ছিলে না; সেই নৃশংস ঘাতক রাতেও তুমি অস্ত্রধারীদের দূর্গের দিকে
অবিচল যাত্রা অব্যাহত রেখেছিলে। ঘাতক বুলেট ভেদ করে গেছে তোমাকে
কিন্তু পিছু হটোনি। তবু বলি: তুমি সাহসী যোদ্ধা। তুমি সময়ের
শ্রেষ্ঠ সন্তান।
যুগে যুগে সংগ্রামীদের অফুরান প্রেরণা।

মধুর ক্যান্টিনে যাই
অরুণের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
কাউন্টারের সামনে কতদিন তোমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
চা খেয়েছি, কতদিন তুমি আমাকে চা’র পয়সা দিতে দাওনি’
কতদিন চায়ের সঙ্গে একটি সিঙারা বা কেকের আবদার করেছ,
কতদিন তোমার সঙ্গে খোশগল্প, হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছি
বসু, আজ সব কথা মনে পড়ে যায়
রিপার বিয়েতে তুমি বলেছিলে অ্যাকশানে আপনার আর আগে
থাকার দরকার নেই, আমরা তো আছি।’
বসু, তুমি আমার শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার একটি রক্তকরবী বৃক্ষ।

মধুর ক্যান্টিনে যাই
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়।
তোমার মৃত্যুর সেই নৃশংস ঘাতক রাত্রিতে
আমি ছিলাম ঢাকার বাইরে
তোমার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ আমি দেখিনি
(আমি শুধু জীবন্ত রাউফুন বসুনিয়াকেই চিনি; সে মরেনি,
সে বেঁচে আছে, এদেশের লক্ষকোটি মানুষের হৃদয়ে সে
ঠাঁই খুঁজে নিয়েছে।)
তোমার মৃত্যুর খবর শুনে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিল মন
তবু সেই রাত্রেই আড়াইশত মাইল দূর থেকে সঙ্গে সঙ্গে রওনা
দিয়েছিলেম তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে; তোমার খুনিদের রক্তে
হাত রাঙাতে।
বসু, আমরা বহুবার তোমার হত্যার প্রতিশোধ নেবার
শপথ গ্রহণ করেছিঅপরাজেয় বাংলার পাদদেশে, শহীদ মিনারে,
বটতলায়, বায়তুল মোকাররমে; সারাদেশ তোমার হত্যার বদলা চায়।
কিন্তু এখনো তোমার খুনিরা প্রকাশ্যে সগর্বে ঘুরে বেড়ায়,
এখনো তোমার ঘাতকেরা ক্ষমতার কালো কেদারায় বসে রাইফেল
তাক করে আছে আমাদের প্রতি।
বসু, আমাদের শিক্ষানীতি এখনো বদলায়নি
সামরিক খাতে ব্যয় শিক্ষাখাতের চেয়ে আরো বেড়েছে
নতুন নতুন ক্যান্টনমেন্ট তৈরির পরিকল্পনা হলেও সংস্কারের
অভাবে জগন্নাথ হলের জীর্ণ ছাদ ধসে তোমার অনেক বন্ধু মারা গেছে
এখনো হলে হলে মেধাভিত্তিক সিটবণ্টন চালু হয়নি
ডাইনিং হলের ভাতে দাঁত ভাঙে এখনো কাঁকর আর ডালে হাত ধোয়া যায়
এক পিছ মাছ কিংবা মাংস গড়াগড়ি যায় সেই গোলাকার বাটিতেই
বসু, তুমি এসবের পরিবর্তন চেয়ে জীবন দিয়েছো
কিন্তু আমরা এখনো তোমার একটি স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করতে পারিনি,
বসু, তোমার কাক্সিক্ষত লড়াই চূড়ান্ত করতে পারিনি
আমরা তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারিনি
আমরা এখনো অজস্র বসু হতে পারিনি বলেই।

মধুর ক্যান্টিনে যাই
বসু, তোমাকে মনে পড়ে যায়
খু-উ-ব মনে পড়ে
মনে পড়ে।